টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আলমনগর ইউনিয়নের আলমনগর মধ্যপাড়া গ্রামের ভ্যানচালক লাল মিয়া ও রেহেনা বেগম দম্পতির একমাত্র ছেলে সন্তান হৃদয় (২০)। গত ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি। ঘটনার পর প্রায় দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও ছেলের লাশ খুঁজে পাননি পরিবার ও স্বজনেরা।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিজয় মিছিলে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছেন হৃদয় মিয়া। তিনি ছিলেন তার বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে সন্তান। ছেলের লাশের ভিডিও দেখেছেন মা। কিন্তু দেড়মাস প্রায় হয়ে গেল, এখনও মেলেনি সন্তানের লাশ। ছেলে হারানোর শোক আর অভাবের তাড়নায় দিশেহারা মা রেহানা বেগম। তার কান্না আর আহাজারিতে বিদীর্ণ মধ্যপাড়া গ্রাম।

টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার আলমনগর ইউনিয়নের আলমনগর মধ্যপাড়া গ্রামের ভ্যানচালক লাল মিয়া ও রেহেনা বেগম দম্পতির একমাত্র ছেলে সন্তান হৃদয় (২০)। গত ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি। ঘটনার পর প্রায় দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও ছেলের লাশ খুঁজে পায়নি তার বাবা-মা।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রবিন মিয়া বলেন, ‘কোনাবাড়ীতে আমরা বিজয় মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম। মেট্রো থানার সামনেই আমরা অবস্থান নিয়েছিলাম। পুলিশ আমাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য টিয়ালশেল ও গুলি করে। তখন অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এ সময় আমরা একপাশে ছিলাম,আর হৃদয় ছিল অন্যপাশে। একপর্যায়ে হৃদয় একটি বিল্ডিংয়ের পাশে লুকায়। পরে সেখান থেকে পুলিশ তাকে ধরে সড়কের উপর নিয়ে যায়। মনে করেছিলাম মারধর করে ছেড়ে দেবে। কিন্তু তারা হৃদয়কে গুলি করে হত্যা করে।

তিনি বলেন, ‘এ সময় পুলিশ চতুর্দিকে গুলি করতে থাকে। ভয়ে এগিয়ে যেতে পারিনি। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম তার মৃত্যু। ভেবেছিলাম পরিবেশ শান্ত হলে তার লাশ আনতে যাব। পরে পুলিশ তার লাশ নিয়ে চলে যায়। যেখানে তাকে হত্যা করা হয়েছে সেখানে শুধু তার রক্তাক্ত লুঙ্গি পাওয়া গেছে। লাশ আর পাওয়া যায়নি।’

হৃদয়ের বোন জামাই ইব্রাহিম হোসেন বলেন, ‘আমরা দুজন এক বাসায় থাকতাম। ঘটনার সময় আলাদা জায়গায় ছিলাম। মিছিলে গুলির ঘটনায় আমি কোনাবাড়ী থানাসংলগ্ন একটি বাসায় আশ্রয় নিই। ওই বাসার গেট থেকে দেখতে পাই চারজন পুলিশ সদস্য গুলিবিদ্ধ একজনকে চ্যাংদোলা করে থানার সামনে নিয়ে বেঞ্চের আড়ালে লুকিয়ে রাখেন। হৃদয়ের মতো দেখতে হলেও গুলির ভয়ে তখন কাছে যাওয়ার সাহস পাইনি। ঘটনার পর হৃদয়ের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। থানাসহ বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করেও হৃদয়ের সন্ধান পাইনি। পরে ঘটনাস্থল থেকে তার পরনের লুঙ্গি পাওয়া গেলে নিশ্চিত হই যে নিহত যুবক হৃদয় এবং তার লাশ গুম করা হয়েছে। আমরা এর বিচার চাই।’

ওইদিন ঘটনাস্থলের আশপাশের বাসা থেকে ধারণ করা কয়েকটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, ১০-১২জন পুলিশ সদস্য এক যুবককে ধরে সড়কের উপর নিয়ে লাঠিচার্জ করছে। এরপর তাকে চতুর্দিকে ঘিরে ফেলে মারধর করছে। এরমধ্যে হঠাৎ করেই একজন পুলিশ সদস্য সামনা-সামনি গুলি করে। এতে মুহুর্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন হৃদয়। পরে পুলিশ সদস্যরা সেখান থেকে চলে যায়। এরপর আবার দুইজন পুলিশ সদস্য তার হাত এবং দুইজন তার পা ধরে নিয়ে যায়।

আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, তিনজন পুলিশ সদস্য তাকে টেনেহিঁচড়ে একটি গলির ভেতর নিয়ে যাচ্ছে।

এ সময় আশপাশ থেকে প্রচণ্ড গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এরপর ওই তিনজন তার লাশ ফেলে চলে যায়। তার একটু পর আবার দুইজন এসে তার লাশ গলির ভেতর নিয়ে গেছে।

সরেজমিনে হৃদয়ের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একমাত্র ছেলে হৃদয়কে হারিয়ে তার মা পাগলপ্রায়। বাড়িতে রাখা ছেলের জামা-কাপড়, খেলাধুলায় পাওয়া বিভিন্ন পুরস্কার হাতে নিয়ে কাদঁছেন আর বিলাপ করছেন। প্রতিবেশীদের সান্তনায় কান্না থামছে না রেহানা বেগমের। বাকরুদ্ধ বাবার দুই চোখে অঝোর অশ্রুধারা।

হৃদয় বাড়ির একটি জরাজীর্ণ ঘরে থাকতো। তার বোন জামাইয়ের দেয়া একটি ঘরের একপাশে থাকে তার বাবা-মা। সেই ঘরেই নিহত হৃদয়ের জামা-কাপড় ও বিভিন্ন জিনিসপত্র রাখা। প্রতিদিনই ওই বাড়িতে গ্রামের লোকজন ভিড় করছেন পরিবারটিকে সান্তনা দিতে।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, হৃদয় গোপালপুর উপজেলার হেমনগর ডিগ্রি কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার দুইবোনের অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। তার বাবা লাল মিয়া এলাকায় ভ্যান চালাতেন। তবে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় কয়েকমাস ধরে তিনি আর ভ্যান চালাতে পারেন না। এই অবস্থায় নিজের পড়াশোনার খরচ ও সংসার চালানোর জন্য কাজের সন্ধানে প্রায় তিন-চার মাস আগে গাজীপুরের কোনাবাড়ী যান হৃদয়। পরে সেখানে একটি অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে চালাতেন।

হৃদয়ের বোন জিয়াসমিন আক্তার বলেন, ‘ফোনে ঘটনার দিন বিকালে হৃদয়ের সাথে সর্বশেষ কথা হয়েছে। হৃদয়কে বলেছি তুমি নিরাপদে থেকে বাসায় ফিরে যাও। তাকে আমার স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। এর প্রায় আধাঘন্টা পরই আমার স্বামী ফোনে জানান আমার ভাই বেঁচে নেই।’

তিনি বলেন, ‘ভাইয়ের আশা ছিল লেখাপড়া করে চাকরি করবে। বাবা-মায়ের মুখে হাসি  ফোটাবে। কিন্তু সেই স্বপ্ন পুলিশ শেষ করে দিল। যারা আমার ভাইকে হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই।’

হৃদয়ের মা রেহেনা বেগম বলেন, ‘আমাদের ভালো রাখা ও পড়াশোনা করার জন্য হৃদয় কোনাবাড়ীতে কাজ করতে গিয়েছিল। ১০ হাজার টাকা কিস্তি তুলে আমার বাবাকে দিয়েছিলাম গাড়ি চালানো শিখতে। আমার বাবা আর গাড়ি চালাবে না। সেই কিস্তির টাকা এখন কে দিবে। আমার বাবাটাকে  মেরে ফেলেছে পুলিশ গুলি করে। আমার ছেলের লাশ ফেরত দিন। আমি দেখবো একটি বার। আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই।’

হৃদয়ের বাবা লাল মিয়া বলেন, ‘ঘটনার দিন তাকে বাড়িতে আসতে বলেছিলাম। কিন্তু ছেলে বললো, ভাইয়ের (বোন জামাই) সাথে যাবো। আমরা বাবাটা আর আসলো না। আমার বাবার লাশ ফেরত চাই।’

আলমনগর ইউনিয়নের সাবেক মেম্বার আব্দুল হামিদ বলেন, ‘কোনাবাড়ীতে আমার দোকান আছে। মিছিলের আগে হৃদয় আমার দোকানের সামনে ছিল।  সে সময় তার বোন জামাইও ছিল। তাদের মিছিলে যেতে মানা করেছিলাম। তারপরও তারা আনন্দ মিছিলে যোগদান করে। বোনের জামাই দূর থেকে দেখেছে কিভাবে হৃদয়কে গুলি করে মেরেছে পুলিশ। কিন্তু ভয়ে কেউ সামনে যাওয়ার সাহস পায়নি।’

তিনি হৃদয়ের লাশ শিগগিরই তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর এবং হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তির দাবি জানান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *